অভিবাসন বনাম আন্ত-পারিবারিক সম্পর্ক : কিছু বিশ্লেষণ

বুধবার, ০৩ মে ২০২৩ | ১:০৯ অপরাহ্ণ | 36 বার

অভিবাসন বনাম আন্ত-পারিবারিক সম্পর্ক : কিছু বিশ্লেষণ

চাওয়া পাওয়ার বৈপরীত্য আমাদের সমাজ কাঠামোতে মোটেও নতুন বা অপ্রত্যাশিত নয়। বাঙালি সমাজ কাঠামোতে পরিবার প্রথায় প্রত্যাশা বা নির্ভরতা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। যুগ যুগ ধরে পরিবার প্রথায় চালু থাকা বিশ্বাস আর সামাজিক, সাংস্কৃতিক রীতিনীতি এটিকে একটি অনিবার্য অনুষঙ্গে পরিণত করেছে। সুদীর্ঘ কাল থেকেই বিশ্বাস করা হতো, ছেলে সন্তানরা পারিবারিক ও বংশীয় ঐতিহ্য রক্ষার ধারক। সাংসারিক ও পারিবারিক অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালনে ছেলেরাই গুরুত্বপূর্ণ। তাই পিতা-মাতা ছেলে সন্তানের প্রতি যতটা যত্নশীল বা মনোযোগী হতেন, বিপরীতে মেয়ে সন্তানের প্রতি ততটাই উদাসীন ছিলেন।

অর্থনৈতিক ও শিক্ষা দীক্ষায় অগ্রসর খুবই নগন্য সংখ্যক পরিবার ছাড়া মধ্যবিত্ত ও নিম্ন বিত্ত পরিবারে এটিই ছিলো সাধারণ চিত্র। পরিবারের অভিভাবকরা মনে করতেন, মেয়েরা একটি নির্দিষ্ট সময় পর ভিন্ন পরিবারের সদস্য হবে। তাদের পেছনে পরিবারের কষ্টার্জিত অর্থের বিনিয়োগ, নিজ পরিবারের কোন কাজে আসবে না। যখন কোন পরিবারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ এমন কি পিএইচডি ডিগ্রিধারী ভাইদের বিপরীতে প্রাথমিক বিদ্যালয় পাশ করা মেধাবী বোনদের অস্তিত্ব মেলে, তখনই বৈষম্যের নিষ্ঠুরতম সত্যটি আমাদের সামনে ফুটে উঠে।

বংশ পরম্পরায় আমাদের সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় পুরুষদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিরাজমান । বিগত কয়েক দশকে শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। পরিবারের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারী সমাজ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। নারীর ক্ষমতায়নে সন্তোষজনক না হলেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। কর্ম ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ, শিক্ষা ক্ষেত্রে জাগরণ তৈরীর সাথে সাথে প্রাগৈতিহাসিক ধ্যান ধারণার পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সাথে, একটি মনস্তাত্বিক সংঘাতও তৈরি হচ্ছে। একদিকে পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার ধারাবাহিকতা, অন্যদিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় শিক্ষিত সচেতন নারী সমাজের অংশগ্রহণের আগ্রহ পরিবার কাঠামোতে একধরনের অস্থিরতা তৈরি করছে। ফলশ্রুতিতে মেধাবী তরুণ প্রজন্ম উন্নত সমাজ ব্যবস্থায় অভিবাসনে আগ্রহী হয়ে উঠছে।

মাইগ্রেশন বা অভিবাসনের পেছনে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নানা উপাদান কাজ করে। কখনো কখনো ব্যক্তি তাঁর নিজস্ব ইচ্ছায় অভিবাসী হয় আবার কখনো বা পরিস্থিতি ব্যক্তিকে অভিবাসনে বাধ্য করে। দলভিত্তিক অভিবাসনের মূলে বিদ্যমান পরিস্থিতি মূখ্য ভুমিকা পালন করে, যাকে ফোর্স মাইগ্রেশান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অর্থনৈতিক কারণে অভিবাসন তৃতীয় বিশ্বের দেশ সমুহের একটি স্বাভাবিক চিত্র। বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিদিন বহু সংখ্যক মানুষ অভিবাসী হচ্ছে, যা মুলত পদ্ধতি গত কারণে অস্থায়ী অভিবাসনের আওতায় পড়ে। এ ধরনের অভিবাসন দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে, সমাজ ব্যবস্থায় স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে।

অস্থায়ী অভিবাসনের পাশাপাশি আজকাল স্থায়ী অভিবাসন অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। মেধাবী তরুণ সমাজ, শিক্ষা-প্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তির একটি বড় অংশ আজ উত্তর আমেরিকা, ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে স্থায়ী অভিবাসী হয়ে নাগরিকত্ব গ্রহণ করছে। অনিয়ম, অনাচার কে দায়ী করে সুখের অভিলাষে সদাচার, আর নিয়ম নিষ্ঠার দেশে অভিবাসী হচ্ছে। সামাজিক রীতিনীতির সংস্কৃতি গুলো ধারণ করে এই অভিবাসী শ্রেণি সত্যিই কি তাদের কাঙ্খিত ‘সুখ’ কে খোঁজে পাচ্ছে? অভিবাসনের পেছনের গল্পগুলোই বা কেমন?

এসব স্থায়ী অভিবাসন নিজ মাতৃভূমি বা ছেড়ে আসা সমাজ ব্যবস্থার জন্য কতটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অভিবাসীদের বৃহত্তম অংশটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আগত আর অপেক্ষাকৃত মেধাবী তাতে ভিন্নমত পোষণের সুযোগ নেই।

সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও এটি স্পষ্ট যে কানাডার বাংলাদেশী কমিউনিটির বৃহত্তম অংশটি যুগল জীবনে অভিবাসী হয়েছেন। মেধা আর দক্ষতায় ঈর্ষনীয় সাফল্যের প্রমাণ দিয়ে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পেয়েছেন। বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার রীতিনীতি, মূল্যবোধ, কৃষ্টি, সংস্কৃতির সংগে এখানকার সমাজ ব্যবস্থার ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। এখানকার সমাজে নারী, পুরুষ কে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই। পুরুষের কর্তৃত্ববাদী মানসিকতাকে নারীসমাজ চোখ বুঝে মেনে নেয়ার পরিবেশও এখানে বিরাজিত নয়। তাহলে দু’টো বিপরীত কৃষ্টি ও মূল্যবোধের বৈপরীত্য কি পরিবার কাঠামোতো নতুন কোন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে?

আমাদের বাঙালি সমাজ কাঠামোতে যৌথ পরিবার প্রথার প্রচলন অত্যন্ত সুপ্রাচীন। সমসাময়িক কালে একক পরিবারের প্রথা জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার প্রভাব এখনো অত্যন্ত সুস্পষ্ট। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সন্তান প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পরেও, তাঁদের উপর পিতা-মাতার নির্ভরতা বা প্রত্যাশার মাত্রাটি হ্রাস না পেয়ে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। আজকাল তরুণ তরুণীদের মাঝে একক পরিবারের ধারনা জনপ্রিয় হয়ে ওঠার ফলে, যৌথ পরিবার প্রথার বৈশিষ্ট্য সমূহ এক বিশেষ চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। এই চ্যালেঞ্জে নারী চায় সমতাভিত্তিক সমাজ, আর পুরুষেরা এগিয়ে যায় কর্তৃত্ববাদী মানসিকতায়। এমন দুটি ভিন্ন ধারার মানসিকতা নিয়ে যখন কোন পরিবার অভিবাসী হয়, তখন নতুন সমাজ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য সমূহ তাদের মাঝে আরো নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে গিয়ে কোন কোন সময় আন্ত-পারিবারিক দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, যা বিবাহ বিচ্ছেদের মতো জটিল পরিস্থিতিও তৈরি করে।

কানাডার অভিবাসী সমাজে সেপারেশন বা বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যাটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগ জনক। পরিসংখ্যান কানাডার তথ্য অনুযায়ী, সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়ছে। ২০১০ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ প্রাপ্ত (সেপারেশন বাদে) জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ২.৩৯ মিলিয়ন, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.৭৮ মিলিয়ন যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ৭.০৭ শতাংশ। বিবাহ বিচ্ছেদের এই পরিসংখ্যান নিঃসন্দেহে একটি সমাজ কাঠামোতে বিদ্যমান অস্থিরতারই বহিঃপ্রকাশ। এক সময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ানদের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান থেকে আগত অভিবাসী কমিউনিটিতে বিবাহ বিচ্ছেদ দৃষ্টিগোচর হলেও, বাঙালি কমিউনিটি ছিল তার ব্যতিক্রম। পরিতাপের বিষয়ে আমাদের বাঙালি সমাজেও বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যাটি এখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।

পরিবার সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক নিমকফ তাঁর Marriage and the Family গ্রন্থে বলেন, ‘Family is more or less durable association of husband and wife with or without children or of a man or women alone, with children ‘ সমাজ বিজ্ঞানী অ্যান্ডারসন ও পার্কার এর মতে, ‘Family is a socially recognised unit of people related to each other by kinship, marital and legal ties’ পরিবার সম্পর্কে মার্ক্সীয় সমাজ বিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণ কিছুটা ভিন্নতার হলেও পরিবার একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান, বৈবাহিক ও আইনানুগ সম্পর্কের মাধ্যমে তা প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং রক্ত সম্পর্কের বন্ধনে তা বিস্তৃত হয়- এ বিষয়ে কারও ভিন্নমত নেই।

একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি ও মূল্যবোধের মাধ্যমে পরিবার কাঠামো প্রভাবিত হবে এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক। অভিবাসীরা একটি সমাজ ব্যবস্থায় বিকশিত হয়ে যখন ভিন্নধর্মী অন্য একটি সমাজ ব্যবস্থায় স্থানান্তরিত হয়, তখন সেই সমাজ ব্যবস্থার রীতি নীতি ও মূল্যবোধকে ধারণ করতে গিয়ে এক ধরনের সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এই দ্বন্দ্ব থেকে তৈরি মানসিক দূরত্ব পারিবারিক আন্ত সম্পর্কের ক্ষেত্রে কখনো কখনো চরম বৈরিতার সৃষ্টি করে।

সমতা ভিত্তিক সমাজে আইনানুগ ভাবে সম্পত্তিতে স্বামী স্ত্রী উভয়েরই সমানাধিকার স্বীকৃত। কানাডিয়ান সমাজে অভিবাসীদের বৃহত্তম অংশটি নানা রকম চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়েই তাদের জীবন কে পরিচালিত করে। বাড়ি ভাড়া বা বাড়ির মর্টগেজ, পরিবারের দৈনন্দিন খরচ সহ আনুষঙ্গিক নিত্যপ্রয়োজন মেটাতে অনেক ক্ষেত্রেই একজনের উপার্জন যথেষ্ট নয়, তাই স্বামী স্ত্রী উভয়ের উপার্জন তখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। সালমা ও আজমান ( ছদ্মনাম) বিবাহিত জীবনে অধিক সুখের অভিলাষে কানাডার অভিবাসী জীবন কে বেঁচে নিয়েছিলেন। আজমান তার একক উপার্জন দিয়ে সংসারের খরচ চালিয়ে, ব্যাংকের মর্টগেজ চালাতে পারবেন না বিধায়, দীর্ঘদিন নিজ বাড়িতে বসবাসের স্বপ্নটিকে নিভৃত রেখেছিলেন।

সালমার ভাবনা ছিলো ভিন্ন!! সম্পত্তির অর্ধেক মালিকানার প্রতি তিনি তখন নেশাগ্রস্থ! তাই স্বামীকে একটি বাড়ি ক্রয়ের জন্য নানা ভাবেই প্ররোচিত করেছিলেন। বিপত্তি বাঁধে, মর্টগেজসহ পারিবারিক খরচের যোগান নিয়ে। দেশ সেরা বিদ্যাপীঠের এমবিএ, ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তার চাকুরি ছেড়ে অভিবাসী হয়েছেন। সারভাইভাল চাকুরিতে তার ঘোরতর আপত্তি। কথায়, কথায় আজমানকে ধর্মীয় বিধান মতে স্ত্রী’র ভরণপোষণের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। গোবেচারা আজমান গায়ে গতরে খেটে চলে অবিরত। যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন স্ত্রীর সাথে বাক বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ে। কয়েক বার ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের অপরাধে আরসিএমপি তথা পুলিশের মুখোমুখি হয়েছেন। পরিশেষে সহায় সম্পদ বিক্রি করে মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। বিপত্তি সেখানেও!! আইনগত ভাবে সম্পদের অর্ধেক মালিকানা সালমার। অবশেষে কোর্ট কাচারি হয়ে সমান সমান হিস্যায় সহায় সম্পদের ভাগাভাগি হয়। চুড়ান্ত হয় বিবাহ বিচ্ছেদ।

অভিবাসন কে যারা সুখ-বিলাসের আশ্রয় মনে করেন, অনেক সময়ই তা হিতে বিপরীত হয়। অভিবাসী সমাজের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সাথে, বেড়ে ওঠা সমাজের রীতিনীতি ও মূল্যবোধের দ্বান্দ্বিক সংঘর্ষ আন্ত পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে। ফলশ্রুতিতে প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসাব মেলাতে গিয়ে ব্যক্তির জীবনে তৈরি হয় হতাশা। সেই হতাশা দূরীকরণে আন্ত: পারিবারিক সম্পর্ক একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাই পরিবর্তিত সমাজের মূল্যবোধ কে ধারণ করে, একটি সুন্দর আন্ত পারিবারিক সম্পর্ক সৃষ্টির মধ্য দিয়েই অভিবাসী জীবনে সুখের অনুসন্ধান করতে হবে, অন্যথায় ব্যক্তি জীবনের পাশাপাশি সামাজিক জীবনেও অভিবাসন একদিন মূল্যহীন হয়ে উঠবে।

Development by: visionbd24.com