চবি উপাচার্য মহোদয়, আমরা লজ্জিত!

শনিবার, ১২ নভেম্বর ২০২২ | ৩:২৬ অপরাহ্ণ | 86 বার

চবি উপাচার্য মহোদয়, আমরা লজ্জিত!

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, আমার প্রাণের বিদ্যাপীঠ। যে সময়ে আমি এ শিক্ষাঙ্গনের ছাত্র ছিলাম, মুক্তবুদ্ধি আর প্রগতির চর্চা তখন অবরুদ্ধ ছিল। ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ বলে যারা ক্যাম্পাস প্রকম্পিত করতো, তাদের ছাড়া অন্যদের জন্য সবুজ-শ্যামল ছায়ায় ঘেরা ক্যাম্পাস জীবনে স্থায়ী কোন প্রশান্তি ছিল না। সুশোভিত কারুকার্য খচিত হলগুলোতে রাতের আঁধারে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারাটাও ছিলো সৌভাগ্যের ব্যাপার। তবুও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক ছাত্র হিসেবে আমার গর্বের সীমা নেই। ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি তখনও শিক্ষক রাজনীতি ছিল। তবে এ শিক্ষক রাজনীতি কোনভাবেই, মান সম্মত শিক্ষা ব্যবস্থার অন্তরায় ছিলো না। দক্ষতা,অভিজ্ঞতা, জ্ঞান আর পান্ডিত্যে যাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব ছিলো, সিনেটে ভিসি প্যানেলের নির্বাচনে, সেই গুণীজনরাই প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হতেন। রাষ্ট্রপতি সেই গুণীজনদের মধ্য হতে, একজন কে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাগ্য নিয়ন্তা হিসেবে নিয়োগ দিতেন।

নানা রকম চড়াই-উৎরাই আর প্রতিক্রিয়াশীলদের রক্তচক্ষু কে উপেক্ষা করে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান শিক্ষকরা যখন মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধি ও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চায় নিয়োজিত ছাত্রদের পাশে মানবঢাল হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতেন, এসব দেখে হ্রদয়ের রক্তক্ষরণ থেমে যেতো। স্বৈরাচারের দুঃশাসন আর ষ্ঠীমরোলারের বিরুদ্ধে এই মহান শিক্ষকেরা যখন শক্ত হাতে ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতেন, গর্বে তখন বুকটা ফুলে যেতো। মনে হতো, এঁরা সবাই অধ্যাপক শহীদ শামসুজ্জোহার যোগ্য উত্তরাধিকার। দেশ মাতৃকার অধিকার আদায়ে তাঁদের আপোষহীন মনোভাব, তরুণদের কে দেশপ্রেমে উদ্বেলিত করতো। অনিয়ম আর অনাচারের বিরুদ্ধে তাঁদের আপোষহীন সমর্থনের কথা মনে হলে, শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতায় আজও মনটা ভরে উঠে।

দুর্নীতি, অনিয়ম, অনাচার আজ সামাজিক ব্যাধিতে রুপান্তরিত হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আজ এ ব্যাধির বাইরে নয়। রাজনীতির দুষ্টুচক্রকে ব্যবহার করে উচ্চ শিক্ষা প্রশাসনেও আজ তা ক্যান্সারের রুপ ধারন করেছে।

স্বেচ্ছাচারিতা,স্বজনপ্রীতি যেন মহামারি আকারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কে গ্রাস করেছে। মেয়াদপূর্তির একদিন আগে আত্নীয় পরিজনসহ শতাধিক লোককে নিয়োগপত্র দেয়া, নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত নিজ স্ত্রী কে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান, বছরের পর বছর কর্মস্তলে না থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সকল সুযোগ সুবিধা গ্রহণ, স্বামী-স্ত্রী মিলে নিয়োগ কমিটি গঠন করে নিজ আত্নীয় কে শিক্ষক নিয়োগ, এমন নানারকম তেলেসমাতি দেখে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনও যখন দিশেহারা, তখনও আমার প্রিয় বিদ্যাপিঠ স্বগৌরবেই এগিয়ে যাচ্ছিলো।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তি, রীতিনীতি, মূল্যবোধ আর আচার আচরণে সকলের আদর্শ হবেন, এটিই যখন সমাজের প্রত্যাশিত, সেই সময়ে মূর্খ, অশিক্ষিত মানুষের মতো আচরণ, মাঝে মাঝে সদাসয় সরকারকেও বেকায়দায় ফেলে দেয়। অতি সম্প্রতি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের আমরণ অনশন, সরকার ও ক্ষমতাসীন দলকে কতটা উদ্বিগ্ন করেছিল, এটিই তার প্রমাণ। জাতি সৌভাগ্যবান, জাফর ইকবাল দম্পতি, চরম সংকটে বিশ্ববিদ্যালয়টির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে এক ভিসি মহোদয়ের বাসভবনের সামনে, সন্তানের পিতৃত্বের দাবিতে এক মহিলার আমরণ কর্মসূচী দেখে,পুরো জাতিই তো লজ্জায় মুখ ঢেকেছিল।

সামাজিক ব্যাধির সংক্রমণ যখন দ্রুত প্রসারমান, সেই সময়ে আমার প্রাণের বিদ্যাপীঠের সর্বোচ্চ কর্তা মহোদয়কে কোভিডকালে সর্ব শক্তি নিয়ে ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতে দেখেছি। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা এলামনাইদের সংগে নিয়ে, দুর্যোগ মোকাবেলায় ব্যতিব্যস্ত হতে দেখেছি। সরকারি বরাদ্দের পাশাপাশি সাবেক ছাত্রদের নিয়ে নানা সংগঠনের সহযোগিতায় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে দেখছি। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের পাওয়া না পাওয়ার দ্ধন্ধে সাময়িক কিছু অস্থিরতা ছাড়া, আমার প্রাণের বিদ্যাপীঠে বড় ধরনের কোন নৈতিক স্খলন জাতির দৃষ্টি গোচর হয়নি। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে, অধ্যাপক শিরীণ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতায় ছিলেন কিনা জানিনা, তবে গত কয়েক বছরে তাঁর কর্মকান্ডের তুলনামূলক বিচারে অনেকের কাছেই তিনি গ্রহণযোগ্য ছিলেন।

চারিদিকে মান সম্মত শিক্ষা নিয়ে যখন নানারকম বিতর্ক, সেই সময়ে গবেষণায় আর রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চমকপ্রদ সাফল্য ঈর্ষণীয়। সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা বিসিএস-এ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের ধারাবাহিক সাফল্য তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কেবিনেট সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব থেকে শুরু করে আমলাতন্ত্রে সাবেক ছাত্রদের শক্তিশালী অবস্থান বিশ্ববিদ্যালয়টির সাফল্যকেই প্রমাণ করে। শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে হতাশার চিত্র যখন বাস্তব, তখন রাষ্ট্রযন্ত্রে চবির সাবেক ছাত্রদের শ্রেষ্ঠত্বে একজন সাবেক চবিয়ান হিসেবে সর্বদাই আমাদেরকে আনন্দে উদ্বেলিত করে।

রুচিবোধ, ধর্মবোধ এও নাকি সর্ব শক্তি মানের লীলা!! তবে শিক্ষা, সেই লীলাকে মহান করে তুলে। আর সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক, এঁরা তো জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। আচার-আচরণ, নীতি নৈতিকতায় এঁরা হবেন সমাজের আদর্শ। শ্রদ্ধা আর বিনয় একজন শিক্ষক কে মহান মানুষে পরিনত করে। একজন শিক্ষক কতটা সম্মানিত হতে পারেন, তার অসংখ্য উদাহরণ আমাদের চারপাশে বিরাজমান। প্রধানমন্ত্রী হয়েও বঙ্গবন্ধু কন্যা যখন শিক্ষককে পা ছুঁয়ে সালাম করেন, পরম মমতায় বয়োবৃদ্ধ শিক্ষকের গায়ে ছাদর জড়িয়ে দেন, তখনতো শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার চিত্রই ফুটে উঠে।

অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম, সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, নোবেলজয়ী ড. ইউনুস, ড. অনুপম সেনের মতো গুণীজন বিশ্ববিদ্যালয়টি কে গর্বিত করেছেন। অধ্যাপক ড. এ আর মল্লিক, অধ্যাপক আবুল ফজল, ড. আবদুল করিম, আর.আই চৌধুরী, ফজলী হোসেন, জাতীয় অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজউদ্দীন এর মতো আলোকিত শিক্ষাবিদগণ যে চেয়ারটি অলংকৃত করেছেন, দুই মেয়াদে অধ্যাপক শিরীণ আখতার আক্তার সেই চেয়ারে সমাসীন। ব্যক্তিগত সদাচার আর নৈতিক মূল্যবোধে তিনি তাদের সমমানের না হলেও কাছাকাছি হবেন সেটিতো আকাশকুসুম প্রত্যাশা নয়!!

দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত একটি সংবাদ, সকল প্রত্যাশাকেই যেন অঙ্গারে পরিণত করেছে। অধ্যাপক শিরীণ আখতার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সভায় একজন ডিনকে ‘বেয়াদব, চুপ বেয়াদব। বের হয়ে যান’ বলে শাসিয়েছেন। প্রশাসকের চেয়ারে বসে একজন ভিসি শাসন করতেই পারেন! তবে সেই শাসন হতে হবে বিধি বিধানের আওতায় সীমাবদ্ধ। যাকে তিনি ‘বেয়াদব’ বলে শাসিয়েছেন, তিনি ভিসি মহোদয়ের ছাত্র সমতূল্য কোন জুনিয়র শিক্ষক নন, তিনি নিজ কর্মগুণে একজন স্বনামধন্য সিনিয়র অধ্যাপক, ব্যবসা প্রশাসন অনুষদের ডিন হেলাল উদ্দিন নিজামী। যাঁর দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান আর পান্ডিত্যের কারণে সদাসয় সরকার তাঁকে সিকিউরিটি এন্ড একচেঞ্জ কমিশনের কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। সিবিআইয়ের চেয়ারম্যান, ক্যাপিটাল মার্কেটের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে যিনি পক্ষান্তরে বিশ্ববিদ্যালয়টিকেই সম্মানিত করেছেন, সেই স্বনামধন্য অধ্যাপক কে শালীনতা বিবর্জিত তিরস্কার করে ভিসি মহোদয় কোন মহানুভবতা আর মানবিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দিলেন?

কি অন্যায় করেছিলেন অধ্যাপক নিজামী? গণমাধ্যমের ভাষায়, তিনি আইনের শাসনের কথা বলেছেন, ডিন নির্বাচনের কথা বলেছেন, সিন্ডিকেটে সঠিক প্রতিনিধিত্বের কথা বলেছেন। এর সবই তো গণতন্ত্রের কথা, সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার কথা। যাকে উপাচার্য মহোদয় তিরস্কার করে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন, রাজনৈতিক আস্থা বিশ্বাসেও তো দু’জন একই অঙ্গনেরই মানুষ। তাহলে, বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপন নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপাচার্য মহোদয় সেই মহান শিক্ষককে অপমানিত করে জাতিকে কি উপহার দিলেন?

আমরা লজ্জিত, ভীষণ লজ্জিত!! যে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে নিয়ে দেশে বিদেশে আমরা গর্ব করে বেড়াই, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ভাষা ব্যবহারের দৈন্যতায় আমরা স্তম্ভিত, বিস্মিত!! অধ্যাপক শিরীণ আখতার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা উপাচার্য। এনায়েত বাজার মহিলা কলেজে শিক্ষকতার মাধ্যমে যিনি মহান পেশাটি বেঁচে নিয়েছিলেন, তাঁর শিক্ষকতার বয়স আজ প্রায় চার দশক। নানা চড়াই উৎরাই পেড়িয়ে তিনি আজ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার পছন্দের মানুষ। বিনয় আর মহানুভবতায় তিনি যদি শেখ হাসিনাকে অনুসরণ করেন, পরবর্তী প্রজন্ম আলোকিত হবে। শারীরিক, মানসিক কারণে অনেক সময় মানুষ বিপর্যস্ত হয়, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। অধ্যাপক শিরীণ আখতারের ক্ষেত্রে এমন কিছু হয়ে থাকলে, আমরা ভীষণ মর্মাহত। বিশ্বাস করতে চাই, কলঙ্কিত ঘটনাটি উপাচার্য মহোদয়ের কাছে একটি দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হবে। অভিভাবক হিসেবে সকল দায় মাথায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি রক্ষা এবং সকল চবিয়ানদের উদ্বেগ উৎকন্ঠা নিরসনে উদ্যোগী হবেন। আর যদি তা ‘না’ হয়, মাননীয় উপাচার্য, ‘আমরা লজ্জিত! ভীষণ লজ্জিত!!

Development by: visionbd24.com