সেই সব দিন

সোমবার, ১০ ডিসেম্বর ২০১৮ | ১০:৪৯ পূর্বাহ্ণ | 1019 বার

আমি নাকি দেখতে হুবহু আব্বার মতো। এ শুনে শুনেই বড় হয়েছি।আব্বার পরিচিত জনের কেউ যখনই আমাকে প্রথমবার দেখত, অবাক হয়ে বলত, ইতা কিতা! পুরিতো দেকি বা’পর চে’রা পাইছে। এক্কেবারে তরফদার সাব। ফুল স্টপ!

ছোটবেলায় মৌলভি বাজারের মনু নদী পেরিয়ে মুরুজপুর গ্রামের বাড়িতে পৌঁছলে আমাকে দেখে ফুপুরা নাকু চুম্বণ দিতেন। তরফদার বাড়ীর শ্রেষ্ঠ সন্তান তাদের ভাইর মত চেহারা বলে আদর করে করে বলতেন, আল্লাগো এক্কেবারে আমরার বাইর চেরা!

একবার আমার সুন্দরী স্মার্ট ও উদ্যোমী ছোট খালার কি একটা কর্মকান্ডে দৌড়াদৌড়ি করছিলাম। তখন বড়দের মিটিং সেরে আসা তার এক বান্ধবী নিয়ামত ডাক্তার সাহেবের ভীষন পাওয়ারফুল চশ্‌মা পরা স্ত্রী খালামনিকে বলেন-তোমার দুলাভাইকে অনুষ্ঠান প্রিসাইড করা গম্ভীর দেখে মনে হল টেবিলের ওপারে ছোট্ট শামীমেরই এক গম্ভীর মুখ দেখছি। আমি ভাবতাম এটা একটা কথা হল? একজন পূর্ণ বয়ষ্ক পুরুষের সঙ্গে একটি ছোট্ট মেয়ের চেহারা কি করে এক হয়। আমি কি তাহলে ছেলেদের মত দেখতে? তার উপর ছেলেরা যা করে তার সবই আম্মা আব্বা আমাকে করতে দেন। তাতে কি আরো ছেলে মার্কা হয়ে যাচ্ছি?

কিন্তু আব্বা আমার দুনিয়ার সব চেয়ে প্রিয় মানুষ তাই তার মত হয়েছি তো হয়েছি! তখন আম্মার বান্ধরীরা যে একটা লাইন জুড়ে আমার কিশোরী মনের জন্য উপকার করেছিলেন সেটা হল বাপ’র চেরার পুরি বাগ্য আনে কোল জুড়ি। তাই যখনই স্কুলে একটা পুরষ্কার পেতাম বা শরীর খারাপ নিয়েও নাচে সবার চেয়ে ভাল করে ফেলতাম- ভাবতাম বাপের মত চেহারা বলেই আমি ভাগন্তী হয়েছি।

আব্বাকে নিয়ে আমার কত যে স্মৃতি। আব্বা তার দাড়ি কাটার পুরানো ব্লেড দিয়ে ভাইয়া আমার ও শোয়েবের নখ কেটে দিচ্ছেন। ব্লেডটা কি করে যেনো অর্ধেক করা হয়েছে। আমি খুব চিন্তিত, নখ কাটার পর শবে বরাতে লাগানো মেহেদীর অবশেষ থাকবে কি না। আমি ঘুরে ঘুরে আব্বাকে বলতে চেষ্টা করছি অন্তত আমার কড়ে আঙ্গুলের নখটা সামান্য একটু লম্বা যায় না! তাহলে ঈদের চাঁদ যখন বারন্দার ঐ নীল অপরাজিতার উপর দিয়ে উঠবে- আমি তাকে চাঁদের মত সরু রেখার ঐ মেহেদীর লাল আভাটুকু হাত উঁচিয়ে চাঁদকে দেখাতে পারতাম! আব্বা বল্লেন, কে তোরে কইছে চান্দরে মেন্দী দেখাইলে সোয়াব অইবো?

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আলো থাকতে থাকতেই আমার পালা এলো। আব্বা আমার দু’হাতের নখগুলো যত্ন নিয়ে গল্প বলে বলে কেটে মানুষ ফুলগাছ ছাঁটা হলে যেমন তৃপ্তির সঙ্গে তাকায় তেমনই প্রথমে কচি হাত দু’খানা একত্র করে দেখলেন। তারপর পায়ের পাতাগুলো একত্র করে দাঁড়াতে বললেন। আমি উঠে দাঁড়ালাম। এবার একটা চুমু দিয়ে পেছনে আম্মার দিকে মুখ বাড়িয়ে বললেন, আনোয়ারা শামীম’র আত আর পাও বড় সুন্দর গো! আম্মা বললেন অয় অয়। আমার তখন মনে হল। তাতে কি? পা তো আর মুখে ঝোলাতে পারবো না! সেরকম কিছু একটা বলেছিলাম ও। আজ আর মনে নেই কি বলেছিলাম। তখন আব্বা আরো কি কি বলেছিলেন তাও মনে ণেই। মনে আছে আমাকে নিয়ে সবাই খুব হেসেছিলেন এবং আমার মনে হয়েছিলো চেহারা তেমন না হলে কি আমিতো আব্বার মত খুব স্মার্ট।

নারায়ণগঞ্জে যখন ছিলাম কেশব বাবুর পুকুরের পাশে আমাদের তিনতলা ভাড়া বাড়ি ছিলো । সামনে বেগুনী কচুরিপনায় ভরা ডোবা। স্পানিস মার্কা রেলিং দেয়া দোতলার বারান্দায় দাঁড়ালে চারদিক থেকে এমন হু হু হাওয়া আসতো যে আমার মনে হত আমাদের বাড়িটা একটা দোতলা জাহাজ। আমরা ভাসতে ভাসতে চলেছি। সেই জলে ভাসা জাহাজের খোলে পাটাতনে ইঞ্জিন রুমে জমে উঠতো আড্ডা, মহড়া, গান ও বাদ্য যন্ত্রের মূর্ছনা। শিল্প সংস্কৃতি্র উপ্ত বীজেই আব্বা ও তাঁর বন্ধুরা সারা শহর মাতিয়ে রাখতেন। কোথা থেকে লোকমান হোসেইন ফকির ধরে নিয়ে আসতেন কানাই শীলকে, বাসে করে ঢাকা মুকুলের মহফিল থেকে আসতেন হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ ও মেডিক্যালে পড়ুয়া আমানুদ্দোউল্লাহ। একবার আযান ছবির নৃত্য পরিচালক জাহাংগীর আলম এসে আমাকে ও মাজেদাকে নাচ শিখিয়ে গেছেন। কোরান তেলাওয়াত শিখিয়েছেন আব্বা নিজে।

নারায়নগঞ্জে রাইফেল শুটিং ক্লাব ছিলো। সেখানে আমাদের গুলি ছোড়াও শিখিয়েছেন। মাটিতে শুয়ে ঐ দূরে একটু পাহাড়ের মত ছিলো তাকে চাঁনমারি বলতো সবাই। তো সেদিকে গিয়ে মাটিতে শুয়ে দূরে পোস্টারের মত চৌকো স্থানে ছাপা বৃত্তে শুটিং করতে হত।কি জ্বালা আমি গুলির শব্দে হাত ছেড়ে দিই। এক চোখ বন্ধ করে তাক করতে পারিনা। তখন আব্বা পকেট থেকে আমার বিলেতে থাকা মামাদের দেয়া উপহার মার্ক্স এ্যান্ড স্পেন্সার এর ‘টি’ লেখা আদ্যাক্ষরের সাদা রুমালে আমার এক চোখ বেঁধে দিতেন।

তর্ক বাগিশ ছিলাম বলে ভাইবোনদের কথায় আটকে দিলে আব্বার কাছে ঠিক ধরা পড়তাম। বলতেন, বড় অইয়া ব্যারিস্টার অইবেনিগো মাই? আমি তখন ভাইয়ার ছোট হয়ে যাওয়া ট্রাউজার শার্ট এবং লাল চামড়ার জুতোও পড়ছি। কারণ আব্বা বলেছেন, মেয়েরাও এসব পড়তে পারে এবং সেটাই নাকি ফ্যাশন।

বাসায় আব্বা আম্মাদের বন্ধুরা এলে চা সিংগাড়া সুজির হালুয়ার পর শুরু হত আমাদের দিয়ে তাদের বিনোদনের সেশন। সবাই একখানা করে করে কেটে পড়লেও আমি সুকুমার রায় আবৃত্তি করে খরবায়ু বয় বেগে চারিদিক ছায় মেঘে গেয়ে নেচে হয়রান হয়ে নাও বাইতেই আবার জাগো নারী জাগো নাচতে শুরু করতাম।যতক্ষন না আমাকে থামানো গেছে। ওভাবেই আব্বা যখন আমাদের চার ভাইবোনের মনে সংস্কৃতি ও শিল্পস্পৃহা জাগিয়েছেন- মনে হয় আমাদের ‘স্মার্ট’ করেছেন।

আজও ভাবি পুরুষ শাসিত এ সমাজে ঐ স্মার্ট মানুষটার জন্যই আমার মা ও আমাদের দু’বোনের জীবন অনেক অন্যরকম হয়েছিলো। অনেক নিজের ইচ্ছেমত হয়েছে। আর আজও আয়নায় সামনে নিজের প্রতিবিম্বে আব্বাকে দেখতে পাই। একটু ওঠা ঠোঁট- ঠোঁটের দুপাশের রেখা। চওড়া কপাল। বয়স বাড়লে কি নারী কি পুরুষ তাদের মাতা পিতার মত হয়ে যায়। গলার স্বর অসুখ বিসুখ মেজাজ মর্জি। কেউ বেশি কথা বলে। কেউ চুপ মেরে যায়। আর শুধু মা বাবার কথা বলে।

মাঝে মাঝেতো বাথরুমে এখন তাঁর সঙ্গে কথাই বলি। চুলটা টেনে পেছনে ব্রাশ করে তাকাই। কানে দুল আর নাকে ঝিলিক দেয়া ফুলটা না থাকলে দেখতে আব্বাই হয়ে আছি । তাকে আর আলাদা করে টেনে আনতে হয় না। আমি তাঁর যে শিল্প-স্বভাবও পেয়েছি। তার উদ্যম ও। মায়ের কথা আরেকদিন বলবো। আজ আব্বার মৃত্যু দিবস। আজ আবার রোকেয়া সাখাওয়াতের জন্মদিনও। ওর কথা কত শুনেছি আব্বা আম্মা দুজনের কাছেই। তবে বাবার কথাই লিখলাম।

Development by: visionbd24.com